ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে জেনে বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের উত্তর দিন সহজেই। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬.৪০% লোক বাংলা ভাষায় কথা বলত। এটি সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীরা তাদের রাষ্ট্রীয়ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়। ভাষা আন্দলোনের পটভূমির সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়েই আজকের এই আর্টিকেলটি সাজানো হয়েছে। আজকের এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইল।
কেন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়?
অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র । ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি বেশ কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতাদের প্রচেষ্টার উন্নীত হয়। যার ফলে পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিম নেতারা উর্দু ভাষায় কথা বলতে চায়। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে চায়। এটি সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানি লোকেদের উর্দু ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করে। যার ফলে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি জেনে রাখা জরুরী। কেননা বিগত বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ভাষা আন্দোলনের পটভূমি থেকে নানা ধরনের প্রশ্ন এসেছে। তাই ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন। নিচে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১৯৪৭ সালের ভাষা আন্দোলন
পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অধিকাংশ লোক ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের। পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৮০% লোকই ছিল মুসলমান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৯৭% লোক মুসলমান ছিল। ধর্মের দিক থেকে দুই রাষ্ট্রের মিল থাকলেও ভাষাগত দিক থেকে আলাদা ছিল। তাই পাকিস্তান শুরু হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব জানায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ও সংস্কৃতিক কর্মীরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়।
এরপর ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলার শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করার জন্য দাবি জানানাে হয়। এর জন্য একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করা হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠনটির নাম ছিল তমদ্দুন মজলিস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তারিখে তমদ্দুন মজলিস সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত সংগঠন টি ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। পুস্তিকাটির নাম ছিল : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা – বাংলা না উর্দু?’।
তমদ্দুন মজলিস ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা ভাষা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়। ১৯৪৭ সালের মধ্যই প্রখ্যাত এবং অখ্যাত লেখক বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রতি সমর্থন জানান। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের দাবি উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে জোর করে চাপিয়ে দেয়। যদিও পাকিস্তানের মাত্র ৩.২৭% লােকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু তবুও পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাকটিকেট, রেলের টিকেট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দুভাষা জোর করে ব্যবহার করা হয়।
পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়ােগ পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি পাকিস্তানের গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্বাচন করা হয়। ফলে পূর্ব বাংলার লোকেরা তথা বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তানে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অধিবেশনে ইংরেজি ভাষা ও উর্দুর সাথে ও বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রানাথ দত্তের এই প্রস্তাবে বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই পাকিস্তানের সরকারি ভাষা মুসলমানের তথা উর্দু ভাষা হওয়া উচিত। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি গণপরিষদে প্রত্যাখ্যান করা হলে পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার করার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ তারিখে (২য় বার) বাংলা ভাষার সংগ্রামকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। যেটি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। কিন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলার সরকার বাংলা ভাষার আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে।
সেজন্য সরকারি পুলিশ বাহীনি ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশে ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। শামসুল আলম, শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে সাধারণ-জনসাধারণ লোকেরাও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। এই পরিস্থিতি খারাপ বুঝতে পেরে তৎকালীন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ১৫ মার্চ তারিখে আলােচনায় বসেন এবং ৮ দফা চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের সরকার চুক্তির শর্তগুলি বাস্তবায়ন না করার ফলে ভাষা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এরপর ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তারিখে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট জানায়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায়। এর এভাবেই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ভাষা আন্দোলন পূনরায় আবার শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আর এই ঘোষণার পর ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহবান করে। ৩০ জানুয়ারি সভায় এবং ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। এই বিক্ষোভ মিছিল ঠেকানোর জন্য সারা ঢাকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সরকারি ঘােষণার পর থেকে ছাত্ররা আরও বেশী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ করে ১০ জন করে ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল বের করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকেই এই আন্দোলনের দিনে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন। পুলিশ মিছিলকারীদের উপর লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। যাতে তারা এই আন্দোলন করতে না পারে কিন্তু সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল হোস্টেলের প্রধান ফটকের সামনে এসে পূণরায় আন্দোলন শুরু করে এবং দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ বাহীনি এসে ছাত্রদের তাড়া করে এবং কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। প্রতিবাদ করার জন্য ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষণ করে। আর এই গুলি বর্ষণ করার জন্য শফিক, বরকত, সালাম, জব্বার ঘটনাস্থলে নিহত হন।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উওর সমূহ
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি নিয়ে আপনার মনে বেশ কিছু প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে। তবে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তর।
কত সালে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়?
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে শফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকেই ঘটনাস্থলে নিহত হন।
কত সালে “ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”গঠিত হয়?
১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথমবার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
উপসংহার
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে জেনে রাখা প্রয়োজন। কেননা বিসিএস পরীক্ষায় ভাষা আন্দোলনের পটভূমি থেকে নানা ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে তাই এই সম্পর্কে আজকের আর্টিকেল পড়ে প্রস্তুতি নিতে নিয়ে রাখতে পারেন। এছাড়াও চাকরির প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশ সম্পর্কে ১০ টি বাক্য পড়তে পারেন।
“ভাষা আন্দোলনের পটভূমি” এ বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।
Leave a Reply